কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রকাশ্যে এসেছে। এ আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা প্রতিরোধে দলটি রাজপথে অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। অনেকেই এটিকে রাজনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতারা একে অপরকে দোষারোপ করছেন, যা অনেক ক্ষেত্রে তর্কাতর্কি বা বাদানুবাদ পর্যন্ত গড়াচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দোষারোপ বা বাদানুবাদের ঘটনাকে ছোট করে দেখার চেষ্টা করছেন। তবে কেউ কেউ বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে দলের ভূমিকা এতটাই ভঙ্গুর ছিল যে অনেকেই তা মেনে নিতে পারছেন না এবং একে অপরকে দোষারোপ করে ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করছেন। দলের বিভিন্ন স্তরে আলোচনায় দল পুনর্গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, ঘুরে দাঁড়াতে হলে দল পুনর্গঠনে হাত দিতে হবে, নতুবা পুরোনো মুখ ও পুরোনো নীতি নিয়ে মানুষের মন জয় করা যাবে না। ভবিষ্যতে এ ধরনের ধাক্কা এলে সামলানো কঠিন হবে।
গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সংবাদ সম্মেলনে জানান, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে গত চার দিন মূল্যায়ন সভা করেছেন তাঁরা। তিনি বলেন, ‘গত চার দিনে আমরা যে বৈঠকগুলো করেছি, কোথাও কি হাতাহাতি, মারামারি হয়েছে? তর্ক–বিতর্ক গণতন্ত্রের প্রাণ। আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের চর্চা করে। এখানে বিতর্ক হতেই পারে; কিন্তু কেউ তো মারামারি করেনি। কোনো হাতাহাতি হয়নি।’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে একটি সমন্বয় সভা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় নেতারা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে রাজধানীর যেসব স্থানে ব্যাপক সংঘাত হয়েছে, সেসব এলাকার জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সভা করছে ক্ষমতাসীন দলটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবারের সভার পর তেজগাঁও কার্যালয়ে ওবায়দুল কাদেরের কক্ষে যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন খান এবং ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান (কচি) কোটা সংস্কার আন্দোলনের সংঘাত প্রতিরোধে দলের ব্যর্থতা নিয়ে তর্কে জড়ান। তাঁদের তর্কাতর্কি একপর্যায়ে ধাক্কাধাক্কিতে গড়ায়। তখন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমসহ উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতারা ওই দুই নেতাকে নিবৃত্ত করেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, দলের মধ্যে এভাবে বাদানুবাদ বা তর্কাতর্কির ঘটনা নজিরবিহীন। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে নেতাদের মধ্যে সহিষ্ণুতার ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
আন্দোলনের শুরুতে আওয়ামী লীগ নেতা, জনপ্রতিনিধি ও সমর্থকদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এ নিয়েও দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বসহ বিভিন্ন স্তরে প্রতিক্রিয়া হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভূমিকা না রাখার অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের মোহাম্মদপুর, আদাবর ও শেরেবাংলা নগর থানার ১০৮টি ইউনিট কমিটির মধ্যে ২৭টি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। দলের নেতারা বলছেন, মহানগরে নেতৃত্বের বিভেদের কারণেই সাংগঠনিক অবস্থা এখন ভঙ্গুর।
গত মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ এবং দলীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে যৌথ সভায়ও দলের দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেই বৈঠকেও নেতা-কর্মীদের অনেকে দলীয় দুর্বলতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বলে জানা গেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ব্যর্থতার দায়ভার বেশি এসেছে সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের ওপর। সংগঠনটির সাবেক এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ এতটা অজনপ্রিয়, তা ভাবনায় আসেনি। সরকার ও আওয়ামী লীগকে দেশের মানুষ কেন অপছন্দ করছে, তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে আরও বিপদ আসতে পারে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা বলছেন, কেন্দ্র থেকে মহানগর, সহযোগী সংগঠন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা এবং হকচকিত হয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা গেছে। এটা হয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ মনে করেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের ব্যাপকতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। এ জন্য এতে বিএনপি-জামায়াত প্রবেশ করে সংঘাতের দিকে নিয়ে গেছে।
0 Iruzkinak